আজ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বাংলা ভাষার জন্য ধুমধাম করে এই দিনটিকে উৎযাপন করে। বাঙালিদের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি গৌরবের একটি দিন। আর বর্তমানে সারা বিশ্বের মানুষ এই দিনটিকে নিজ নিজ মাতৃভাষার জন্য উৎযাপন করে। নিজ মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। যখন মানুষ নিজ এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও যায়, যেখানে সবার ভাষা আলাদা, সেখানে যদি নিজ ভাষায় কাউকে কথা বলতে দেখা যায় তাহলে সে পর হলেও তাকে আপন কেউ মনে হয়। আর এটা হয় ভাষার প্রতি ভালোবাসার জন্যই। আর ঠিক এই কারণে বাংলাদেশিরা অন্য দেশের হলেও ভাষাগত কারণে তাদের প্রতি একটা টান এপার বাংলার মানুষরা অনুভব করে। ওপার বাংলার বাঙালীদেরও একই অবস্থা। ভারত এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবীদের মধ্যেও এই টান বা ভালোবাসা দেখা যায়। এই দিন নিয়ে বেশ ভালোই মাতামাতি হলেও অনেকেই আজকের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানে না। তাই খুব সহজ সরলভাবে সংক্ষিপ্ত করে আমি ব্যাপারটা লিখছি।
১৯৪৭ সালে ইংরেজদের তাড়িয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। ২০০ বছরের পরাধীনতার পর দেশ স্বাধীন হলেও একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়। ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে দুটি দেশ হয়। ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয় বর্তমান পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ নিয়ে। বর্তমান বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল। এই দুই জায়গার মধ্যে দুরুত্ব ছিল অনেক। এছাড়া ভাষা এবং ভৌগলিক জীবনযাপন বা সংস্কৃতিও ছিল ভিন্ন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দেয় পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পূর্ব পাকিস্থানেরও রাষ্ট্রীয় ভাষা উর্দু করা হবে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হলো বাংলা। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলার মানুষ সেটা মেনে নিতে পারেনি। এই সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ প্রতিবাদ করে। ধীরে ধীরে তা বড় আকার ধারণ করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্ররা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে নামে। পাকিস্তানি পুলিশ এই বিক্ষোভে গুলি চালায়। এদিন পুলিশের গুলিতে কয়েকজন তরুণ মারা যায়। যাদের মধ্যে অন্যতম হল, রফিক, আব্দুল জব্বার, আব্দুল সালাম এবং বরকত। এই ঘটনার পর আন্দোলন আরো ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। পরের দিন আরও বেশি ছাত্রছাত্রী সহ সাধারন মানুষ রাজপথে নামে। সারা দেশজুড়ে চলে প্রতিবাদ, মিছিল। পরে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সরকার বাংলাভাষাকে প্রথমে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা এবং ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
এই হলো ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এর পরে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে কানাডায় বসবাসরত রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালামের উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। পরে আরও অনেক সংগঠন এবং মানুষের প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। বেশিরভাগ সদস্য দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়। সেই প্রস্তাবে বলা হয়, এখন থেকে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করবে। তারপর থেকে সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ এবং প্রতিটি ভাষাভাষীর মানুষ এই দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।